কোন্দলে জর্জরিত চট্টগ্রাম বিএনপি : অপরাধে জড়াচ্ছে নেতাকর্মীরা
কোন্দলে জর্জরিত চট্টগ্রাম বিএনপি : অপরাধে জড়াচ্ছে নেতাকর্মীরা
এম মনির চৌধুরী রানা চট্টগ্রাম
আহবায়ক কমিটির তালিজোড়া দিয়ে চলেছে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপি ১১ বছরের রাজনীতি। সর্বশেষ ২০১৪ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত ছিল পূর্ণাঙ্গ কমিটি। বিভিন্ন গ্রুপ উপগ্রুপে বিভক্ত এখানকার নেতাকর্মীরা। এর মধ্যে দুই পক্ষের সংঘর্ষের জেরে গত ২৯ জুলাই বিলুপ্ত করা হয় গোলাম আকবর খোন্দকারের নেতৃত্বাধীন আহবায়ক কমিটি। কথা ছিলো, কয়েক দিনের মধ্যেই দেয়া হবে নতুন একটা কমিটি। তবে প্রায় দুই মাস অতিবাহিত হলে ও কমিটির খবর নেই। যে কারণে অনেকটা অভিভাবকহীন চট্টগ্রাম বিভাগে বিএনপির অন্যতম এই সাংগঠনিক ইউনিটের নেতাকর্মীরা। নেতৃত্ব না থাকায় এদের অনেকেই জড়িয়ে পড়েছেন বিভিন্ন অপরাধে।
মিরসরাই, সীতাকুণ্ড, ফটিকছড়ি, রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, হাটহাজারী, সন্দ্বীপ উপজেলা নিয়ে গঠিত চট্টগ্রাম উত্তর জেলা শাখা বিএনপি। ২০২০ সালের ২২ ডিসেম্বর গোলাম আকবর খোন্দকারকে আহ্বায়ক করে গঠন করা হয় ৪৪ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি। সেই কমিটিতে কোন সদস্য সচিব ও রাখা হয়নি। ছোটখাটো কর্মসূচি ছাড়া বড় কোন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে পারে নি। কোন বড় অর্জন ছিলো না কমিটির। গত বছরের ৫ আগস্টের আগে কমিটির অধিকাংশ নেতারা স্বক্রিয় ছিল না ছিল নিষ্ক্রিয়। তবে শেখ হাসিনার পতনের পর কাজে গতি আসলেও তুমুল কোন্দলে জর্জরিত হয়ে পড়ে মূল নেতৃত্ব। নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব ও প্রভাব বিস্তারের লড়াইয়ে এখানে নিহত হয় অন্তত ১৭ জন। আহত হয়েছেন পাঁচ শতাধিকের বেশি।
উত্তর জেলা বিএনপির উপজেলা কমিটিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নাজুক অবস্থা রাউজানে। এই উপজেলায় নিয়মিত সংঘর্ষে জড়াচ্ছে বিবাদমান দুই গ্রুপ। এক গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সম্প্রতি দলীয় পদ হারানো বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী। আরেক গ্রুপের নেতৃত্বে আছেন উত্তর জেলা বিএনপির সদ্য বিলুপ্ত কমিটির আহবায়ক গোলাম আকবর খোন্দকার। গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে চলতি সেপ্টেম্বর পর্যন্ত উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় মারামারি, গুলিবর্ষণ, গাড়ি ভাঙচুর, নেতৃবৃন্দের পদ স্থগিত, কমিটি বিলুপ্তির মতো ঘটনা ঘটেছে, যা দলের ভাবমূর্তিতে প্রভাব ফেলেছে। সর্বশেষ গত ২৯ জুলাই গোলাম আকবর খন্দকার ও দলের গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর অনুসারীদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ঘটে। এই ঘটনার পর উত্তর জেলা কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করেন কেন্দ্রীয় নেতারা।
জানা যায়, আওয়ামী লীগের সময়ে গত ১৬ বছর রাউজানে মিছিল-সমাবেশ করতে পারেনি বিএনপি। গত বছরের ৫ আগস্টের পর সেখানে কর্মসূচি পালন শুরু হয়। আর তখন থেকেই মূলত আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন বিবাদমান দুই গ্রুপ। শুধুমাত্র এই উপজেলায় গত বছরের ৫ আগস্টের পর সহিংসতায় মোট ১৩টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। সেখানে বিএনপির দুই পক্ষে সংঘর্ষ হয় শতাধিকবার। তিন শতাধিক মানুষ এসব ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হন।
একই অবস্থা মিরসরাই উপজেলায়। সেখানে বিবাদমান কয়েকটি গ্রুপ ৫ আগস্টের পর বেশ কয়েকবার সংঘর্ষে জড়িয়েছে। এরমধ্যে গত ২৪ মার্চ মিরসরাই উপজেলা, বারইয়ারহাট ও মিরসরাই পৌরসভা বিএনপির নতুন আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। উপজেলা বিএনপির কমিটিতে আহ্বায়ক করা হয় আবদুল আওয়াল চৌধুরীকে। সদস্যসচিব হন আজিজুর রহমান চৌধুরী। ৮৩ সদস্যের নতুন কমিটির নেতৃত্বে থাকা এই দুজনই উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি নুরুল আমিনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।
কমিটিতে নিজেদের পক্ষের প্রতিনিধিত্ব কম থাকায় সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান নুরুল আমিনের অনুসারীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন।কমিটি গঠনের প্রতিবাদে ২৫ মার্চ দলের এই অংশের নেতাকর্মীরা মিরসরাইয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক বন্ধ করে ঝাড়ুমিছিল ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেন। ২৬ মার্চ ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল করে শহীদ মিনারে ফুল দিতে যান সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান নুরুল আমিনের অনুসারীরা। উপজেলার বারইয়ারহাট পৌরসভার জামালপুর এলাকায় দলের দুই পক্ষের সংঘর্ষে মোহাম্মদ জাবেদ নামের এক যুবক নিহত হন। সংঘর্ষে গুরুতর আহত হন বিএনপির অন্তত ১৩ নেতা কর্মী। পরে কমিটির কার্যক্রম স্থগিত করেন নেতারা।
২৯ জুলাই রাতে রুহুল কবির রিজভীর সই করা চিঠিতে বলা হয়, দলের ভেতর সংঘাত ও হানাহানি সৃষ্টি করে দলীয় শৃঙ্খলা চরমভাবে লঙ্ঘন করায় বিলুপ্ত সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান নুরুল আমিন, মিরসরাই উপজেলা বিএনপির সাবেক সদস্যসচিব গাজী নিজাম উদ্দিন, বারইয়ারহাট পৌর বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক দিদারুল ইসলাম মিয়াজী, যুবদল নেতা সিরাজুল ইসলাম ও কামাল উদ্দিনকে দলের প্রাথমিক সদস্যপদসহ সব পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
এদিকে প্রকাশ্যে হানাহানি না থাকলেও হাটহাজারী উপজেলায় বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এস এম ফজলুল হক ও প্রয়াত সংসদ সদস্য সৈয়দ ওয়াহিদুল আলম চৌধুরীর মেয়ে শাকিলা ফারজানার আলাদা আলাদা পক্ষ রয়েছে। এখানেও কোন্দলের কারণে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা যাচ্ছে না। ফটিকছড়ি,সন্দ্বীপ ও রাঙ্গুনিয়া উপজেলায়ও অনেকটা একই অবস্থা। তবে সীতাকুণ্ডে বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল তেমন দেখা যায় না।
উত্তর জেলা বিএনপির একজন সিনিয়র নেতা নাম প্রকাশ করার শর্তে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে এখানে পূর্নাঙ্গ কমিটি নেই। কারও কথা কেউ শুনেন না। যে যার মতো চলছেন। ফলে দল ক্ষতগ্রস্ত হচ্ছে।সামনে নির্বাচন। শিগগিরই কমিটি দিয়ে মাঠে কাজে নেমে না পড়লে নির্বাচনে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীম বলেন, কিছু বাস্তবতা ও জটিলতা আছে। যে কারণে কমিটি দিতে একটু দেরি হচ্ছে।তবে খুব দ্রুতই কমিটি দেওয়া হবে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Banglar Alo News Admin
কমেন্ট বক্স